ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৪:২৯ অপরাহ্ন | দেখা হয়েছে ১৯১১ বার
মব জাস্টিস: ভিড়ের উন্মাদনায় ন্যায়ের অপমৃত্যু : এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর
“বিচারের বাণী যখন নিভৃতে কাঁদে, তখন রাজদণ্ড আর ধর্মদণ্ড উভয়েই অর্থহীন হয়ে পড়ে।” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটি আজ অপ্রস্তুতভাবে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছে। মব জাস্টিস বা জনবিচার কোনো হঠাৎ আবেগের ঝলক নয়; এটি রাষ্ট্র, সমাজ ও নৈতিকতার দীর্ঘসূত্রী অবহারের ফল। যখন বিচারপ্রক্রিয়া দুর্বল হয়, আইন বিলম্বিত হয়, আর মানুষের আস্থা ভাঙে—তখন ভিড় নিজেকে বিচারক ভাবতে শুরু করে। সেই মুহূর্তেই ন্যায় মাটিতে পড়ে যায় এবং সভ্যতা ব্যথিত হয়।
একটি দৃশ্য কল্পনা করুন: এক নিরীহ মানুষ—যার বিরুদ্ধে কোনো ধার্যপ্রমাণ নেই—শুধু একটি গুজবের ধাক্কায় ভিড়ের সম্মুখে পড়ে। মুহূর্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, মোবাইল ক্যামেরা চালু হয়, কেউ শুধু জিজ্ঞেস করে না—সে দোষী কি না। ভিড় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, শাস্তি কার্যকর করে। জায়গায় বিচার নেই; কেবল হিংসা আর অন্ধ অস্থিরতা।প্রতিটি ঘটনার পেছনে একটি নামহীন জীবন, ভাঙা পরিবারের কষ্ট এবং আইনের প্রতি ভাঙা আস্থা লুকিয়ে আছে।
মব জাস্টিস কী এবং কেন এটি ভয়ঙ্কর:
মব জাস্টিস বলতে বোঝায়—প্রমাণ-পরীক্ষা বা আদালত ছাড়াই ভিড়ের সিদ্ধান্তে কাউকে শাস্তি দেওয়া: মারধর, অপমান, আটক বা হত্যা। এটি বিচার নয়; এটি মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ (UDHR, ICCPR) স্পষ্টভাবে বলে—ন্যায্য প্রক্রিয়া ও প্রমাণ ছাড়া কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। ‘Presumption of Innocence’—অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত সবাই নির্দোষ—এই মৌলিক নীতিকেই মব জাস্টিস ধ্বংস করে।
ভিড় কেন বিচারক হয়ে ওঠে — বিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্ব:
মব জাস্টিস কেবল নৈতিক ব্যর্থতা নয়; এর পেছনে আছে মনস্তাত্ত্বিক ও নিউরো-বিজ্ঞানগত কারণ:
*ডি-ইন্ডিভিডুয়েশন: ভিড়ে ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত দায়বোধ হারিয়ে ফেলে; ‘আমি’ বিলীন হয়ে ‘আমরা’ হয়ে ওঠে।
*মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া: উত্তেজনায় যুক্তি নিয়ন্ত্রণকারী প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কাজ কমে যায়, ভয়-আগ্রাসনের কেন্দ্র অ্যামিগডালার প্রভাব বাড়ে।
*রাসায়নিক উত্তেজনা: অ্যাড্রেনালিন ও ডোপামিন সহিংস আচরণকে ত্বরান্বিত করে।
*ডিজিটাল অনুঘটক: সোশ্যাল মিডিয়া গুজবকে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়—ভাবার সময় না দিয়ে আঘাতকে উৎসাহিত করে। সংক্ষেপে: গুজব + ভয় + ভিড় + প্রযুক্তি = ন্যায়ের পতন।
দর্শন ও সাহিত্য: সতর্কবার্তা:
দর্শন বহু আগেই সতর্ক করেছে—থমাস হবস বলেছিলেন আইন না থাকলে সমাজ ‘জঙ্গলরাজে’ পরিণত হয়; প্লেটো ও কান্ট দেখিয়েছেন যে ন্যায় হল যুক্তি, প্রক্রিয়া ও মানবিক মর্যাদার মিলন, প্রতিশোধ নয়। সাহিত্যও এই সতর্কবার্তাকে তার রূপ দিয়েছে: To Kill a Mockingbird, The Lottery, Lord of the Flies—এসব কাহিনি দেখায় কিভাবে ভিড় অন্ধ হয়ে নিরীহকে বলি দেয়। এগুলো কল্পকাহিনি নয়; এগুলো আমাদের আয়না।
ইতিহাস: বারবার লেখা রক্তচিত্র:
মব জাস্টিস নতুন নয়—ইতিহাস জুড়ে এর রক্তাক্ত ছাপ মিলবে: যুক্তরাষ্ট্রে শতাব্দীব্যাপী লিঞ্চিং, দক্ষিণ আফ্রিকায় নেকলেসিং, ভারতে ও আফ্রিকায় গুজবভিত্তিক গণপিটুনি। বাংলাদেশেও ২০১৯ সালের ‘ছেলেধরা’ গুজব ও উত্তর বাড্ডার রেনুর মতো ঘটনা প্রমাণ করে যে ভিড়ের রাগ কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে—প্রায় সব ক্ষেত্রেই পরে দেখা গেছে ভুক্তভোগীরা নির্দোষ ছিলেন।
ধর্ম ও নৈতিকতা: একক কণ্ঠে প্রতিবাদ:
বৃহৎ ধর্মসমূহ মব জাস্টিসকে নিন্দা করে—ইসলাম মানুষ হত্যা নিন্দা করে, খ্রিস্টধর্ম “নির্দোষ প্রথম পাথর ছুঁড়ুক” বলে সহনশীলতা শেখায়, বৌদ্ধধর্ম করুণা ও অহিংসার শিক্ষা দেয়, হিন্দুধর্মে ‘মৎস্যন্যায়’ বা বলবৎকে নিন্দা করা হয়েছে। ধর্ম এখানে বিভাজন নয়; বরং মানবিকতার ঐক্যবোধ।
সামাজিক ও আইনি ক্ষতি:
মব জাস্টিসের দীর্ঘমেয়াদি ফল ভয়ানক— আইনের ওপর আস্থা ক্ষয় হয়, সহিংসতা “সমাধান” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে,নিরীহ পরিবার চিরস্থায়ীভাবে ন্যায়বঞ্চিত হয় এবং সমাজে ভয় ও অবিশ্বাস স্থায়ী হয়ে ওঠে।
সবচেয়ে বিপজ্জনক সত্যটি হলো—আজ যাঁরা ভিড় চালায়, আগামীকাল তাঁরাও গুজবের শিকার হতে পারেন।
প্রতিরোধ: বাস্তব ও সমন্বিত পদক্ষেপ:
মব জাস্টিস ঠেকাতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ—
১. আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: মব জাস্টিসকে স্পষ্ট অপরাধ হিসেবে ঘোষণা, দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচার চলানো।
২. পুলিশ ও প্রশাসন: কমিউনিটি পুলিশিং, দ্রুত প্রতিক্রিয়া ইউনিট, ফরেনসিক সক্ষমতা বাড়ানো।
৩. ডিজিটাল সচেতনতা: ফ্যাক্ট-চেক ব্যবস্থা, গুজব দমন, মিডিয়া লিটারেসি প্রশিক্ষণ।
৪. শিক্ষা ও সংস্কৃতি: স্কুলে নাগরিক শিক্ষা, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে মানবিকতা ও আইনের মর্যাদা তুলে ধরা।
৫. ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্ব: নেতা ও ধর্মগুরুদের শান্তির বার্তা উৎসাহিত করা।
৬. নাগরিক দায়িত্ব: যাচাই ছাড়া শেয়ার না করা, সহিংসতা দেখলে পুলিশকে জানানো, সহমর্মিতা প্রদর্শন করা।
উপসংহার: এক মানবিক আহ্বান:
মব জাস্টিস ন্যায় নয়—এটি সভ্যতার আত্মঘাতী পদক্ষেপ। রাষ্ট্র ও আদালত যখন নীরব বা দুর্বল, ভিড় সেই শূন্যস্থান ভরতে রক্ত প্রদর্শন করে। প্রতিটি গুজব, প্রতিটি তাড়াহুড়া সিদ্ধান্ত, প্রতিটি আঘাত—একটি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, যা আর ফিরে পাওয়া যায় না।
ন্যায় টিকে থাকে বিবেক, আইন ও সাহসে—ভিড়ের আগুনে নয়। আজ যদি আপনি গুজবের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, সত্য যাচাই করেন, সহিংসতা দেখলে প্রতিবাদ করেন—তাহলে হয়তো একটি জীবন রক্ষা করা যাবে।
এম.এ.এ. বাদশাহ্ আলমগীর
Advocate
The Subordinate Courts of Bangladesh
Associated with Practice at the High Court
Legal Advisor, Apradhchokh24.com