ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১০:০১ পূর্বাহ্ন | দেখা হয়েছে ৪৩ বার
বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে সমুদ্র পথে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন বেড়েছে। এর প্রধান কারণ জনশক্তি রপ্তানি খাতে সীমাহীন দুর্নীতি ও প্রতারণা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, বোয়েসেলসহ জনশক্তি রপ্তানিসংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েকটি বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জনগণের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির স্বার্থ রক্ষায় বেশি তৎপর থাকেন। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার যোগসাজশে এসব জনশক্তি রপ্তানি কারবারি হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। তারা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে যায়। বিদেশে গমনেচ্ছু কর্মীদের সঙ্গে নানান অনিয়ম করে। তাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করে। ভুয়া নিয়োগপত্র দেওয়া, বেতনের ভুল তথ্য দিয়ে তারা অভিবাসনে আগ্রহীদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যেহেতু এসব রিক্রুটিং এজেন্সির আঁতাত রয়েছে তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এভাবেই এক দুষ্টচক্রের হাতে বন্দি আমাদের জনশক্তি রপ্তানি। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) বহির্গমন শাখা মূলত বিদেশগামী কর্মীদের নিরাপদ, বৈধ ও সুশৃঙ্খল কর্মসংস্থানের দায়িত্বে নিয়োজিত। এ শাখাটি ‘রেসট্রিকটেড এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ এবং প্রতিটি ফাইল যাচাই হয় নিয়মমাফিক। কিন্তু অফিসের নির্ধারিত সময় শেষ হতেই চিত্র বদলে যায়। সন্ধ্যা নামতেই সরগরম হয়ে ওঠে নানান এজেন্সির লোকদের আনাগোনায়। সক্রিয় হয়ে ওঠে অসাধু সিন্ডিকেট। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ারে বসে নিজেরাই কাজ সারেন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা। এক দিনে ৭৯টি ফাইল অনুমোদন, জাল ও এডিটেড পাসপোর্ট দিয়ে ছাড়পত্র-এসব কার্যক্রমের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অনেক এজেন্সির সৌদিতে কর্মী পাঠানোর অনুমোদন নেই, তবু তারা অসংখ্য শ্রমিক পাঠিয়েছে। সহায়সম্বল বিক্রি করে স্বপ্ন দেখা প্রবাসীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সরকারি সার্ভারে অসাধু চক্রের অবাধ প্রবেশের ফলে নাগরিকদের তথ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। নিয়ম, নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার মুখোশের আড়ালে এ অনিয়মের আসর চলছেই।
বিএমইটির বহির্গমন শাখা বৈধ চুক্তিপত্র যাচাই করে বিদেশগামী কর্মীদের ক্লিয়ারেন্স প্রদান করে। তাদের ক্লিয়ারেন্স না পেলে কেউ বিদেশে কাজ করতে যেতে পারে না। রিক্রুটিং এজেন্সির কার্যক্রম তদারকি, চুক্তির শর্ত বিশ্লেষণ ও কর্মীদের অধিকার রক্ষাও এ শাখার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তারা প্রত্যেক বিদেশগামী কর্মীর তথ্য ডেটাবেসে সংরক্ষণ করে, যাতে ভবিষ্যতে সরকারিভাবে সহায়তা দেওয়া সহজ হয়। প্রতারণা বা জাল কাগজপত্র শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণও বহির্গমন শাখার কাজের অংশ। অনলাইন সেবার মাধ্যমে সহজ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বহির্গমন ক্লিয়ারেন্স প্রদান করা হয়। এজন্যই এ অতিগুরুত্বপূর্ণ শাখাটি প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত বা ‘রেসট্রিকটেড এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে বহির্গমনসংক্রান্ত কোনো অভিযোগ থাকলে তা জানানোরও একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও সময় রয়েছে। বহির্গমন শাখার একজন কর্মকর্তা দিনের নির্দিষ্ট সময়ে বিএমইটির প্রশাসনিক ভবনে বসে সবার অভিযোগ শোনেন এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। তবে অনুসন্ধান বলছে, এসব নিয়মকানুন শুধু যারা বৈধভাবে কাজ করেন, তাদের জন্যই প্রযোজ্য। অন্যদিকে একটি অসাধু প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এসব নিয়মকানুন না মেনে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো কাজ করে। এমনকি এ প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ কক্ষে তারা অবাধে প্রবেশ করেন। অফিস টাইম শেষে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সিন্ডিকেটের লোকজন। অবাধে প্রবেশ করে সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ার-টেবিলে বসে নিজেরাই নিজেদের কাজ সম্পন্ন করেন। কোনো ধরনের নিয়মকানুন না মেনে তারা অনুমোদন করান নিজেদের ফাইল। আর চক্রটির সঙ্গে বিএমইটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত থাকায় তদারকিও কার্যকর হয় না। এর ফলেই বিদেশে পাড়ি জমানো শ্রমিকরা প্রতিনিয়িত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এর বাইরেও সরকারি সার্ভারে অসাধু চক্রের অবাধ প্রবেশের কারণে নাগরিকদের তথ্য অনিরাপদ হওয়ার প্রবল ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। জুলাই ও আগস্টে বিভিন্ন সময়ে ওই ভিডিওগুলো ধারণ করা হয়েছে।
গত জুলাই এবং আগস্টে সংগৃহীত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, টি-২০ ওভারসিজের (আর এল নম্বর ১৪১৫) ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান আক্তার ‘প্রবেশ নিষেধ’ বহির্গমন শাখা থেকে বের হচ্ছেন। এই নুরজাহানের বিরুদ্ধে বিএমইটিতে নানান প্রতারণা ও অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একাধিক মামলা রয়েছে। আর একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দি ইফতি ওভারসিজের (আর এল নম্বর ৮৯৪) ব্যবস্থাপনা অংশীদার মো. রুবেল বহির্গমন শাখায় প্রবেশ করছেন। এ সময় দরজার সামনে থাকা প্রহরী তাঁকে দরজা খুলে দেন। তাকওয়াহ ওভারসিজের (আর এল নম্বর ১৯৪৫) ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিমকে বহির্গমন শাখার ভিতরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বিএমইটিতে আধিপত্য রয়েছে এম এস মক্কা ওভারসিজের (আর এল নম্বর ১১৭৫) মো. জামাল হোসেন ও মিজান সলিউশন সার্ভিসের (আর এল নম্বর ২৭৭৮) মো. মিজানুর রহমানের। অনুসন্ধানে এসব এজেন্সির ইতিহাস খুঁজে নিয়মকানুন না মেনে শত শত কর্মী বিদেশে পাঠানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মিজান সলিউশনের সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর অনুমোদনই নেই। তবু তিনি অসংখ্য কর্মীকে বিদেশে পাঠিয়েছেন, যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এমন কিছু কর্মীর পাসপোর্ট নম্বর হলো এ০১২০৯৪৬৬, এ১৪৪৭৪৪৩, এ০২৮৪২২৮০, এ০৩৭৬৮৪৮৩, এ০৫০৯০৪১১, এ০৫৯৮৬২৭৮, এ০৬৫৭৪৫৬৩, এ০৭৩২৪০৮৭, এ০৭৯৯১৫০২, এ০৮৬১৩৫৬০, এ০৮৬১৯৬০৭, এ০৮৯২৪৩৫৯, এ১২৪৮২৪৫৭, এ১৫৩১৮৭৯০, এ১৫৬৭২৬৬৭, এ১৬০৯৯৬৯০, এ১৬১২০৪৮৩, এ১৬২২৪৫৪৭, এ১৬৪৯৩৭৯২, এ১৬৮৯০২২৮, ইজে০৮৩৩৩৪১ ও ইএল০৭২৩২০১।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএমইটিকেন্দ্রিক অসাধু সিন্ডিকেটের প্রধান নিয়ন্ত্রক টি-২০ ওভারসিজের নুরজাহান আক্তার ও দি ইফতি ওভারসিজের মো. রুবেল। তাঁরা নিজেদের এজেন্সির বাইরেও অন্তত ৫০টি এজেন্সির হয়ে কাজ (দালালি) করেন। নুরজাহান আক্তার ছিলেন বিএমইটির তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। বিএমইটিতে চাকরিকালে তিনি জড়িয়ে পড়েন নানান অনিয়মে। এরপর দুদকের একটি মামলায় চাকরি হারান। চাকরি হারিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েন নুরজাহান। বিএমইটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য করে গড়ে তোলেন ভয়ংকর মানব পাচার চক্র। নিয়ম না মেনে তিনি বিদেশে পাঠিয়েছেন এমন কিছু শ্রমিকের পাসপোর্ট নম্বর হলো এ০৮৪৩৮১৫০, এ১৩৪৮৯১৭৫, এ১৭৯৫১৮০৮, এ১৭৮১০৬৯০ ও এ১৭৯১৩৪৯৭। এ চক্রে নুরজাহানের অন্যতম সহযোগী দি ইফতি ওভারসিজের মো. রুবেল। বিএমইটিতে দুজনেরই রয়েছে অবাধ যাতায়াত। অন্যান্য এজেন্সি নিয়ম মেনে কাজ করতে গেলে তাদের দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। অথচ নুরজাহান-রুবেল নিজেরাই বহির্গমন শাখায় গিয়ে দিনে দিনে তাঁদের কাজ করিয়ে নেন। যেমন গত ২০ মে একই দিনে নুরজাহান আক্তারের ৭৯টি ফাইল অনুমোদন (অ্যাপ্রুভ) করা হয়। একইভাবে ১৭ মার্চ রুবেলের দি ইফতি ওভারসিজ থেকে একই দিনে অ্যাপ্রুভ করা হয়েছে ২০টি ফাইল। এ ছাড়া ইফতি ওভারসিজের মাধ্যমে ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর বসিয়ে এডিট করা পাসপোর্ট দিয়েও নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর তথ্য পাওয়া গেছে। এমন কিছু পাসপোর্ট নম্বর হলো এ১১৫০০৬৩৭, এ১৪৭০৪৮৩২, বিআর০৮৬৯৮০২, এ১৭৪০৫৫৫১, একে০৬৯৯৩৪৫ ও ইকে০২৫১১৭২।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্যই বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিতে এখন অচলাবস্থা চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশন কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বিএমইটি ঢাকার কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও বিভিন্ন এজেন্সির বিরুদ্ধে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে নারীদের বিদেশে পাচারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধান কার্যালয় থেকে ২৯ মে বিএমইটিতে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে দেখা যায়, বিভিন্ন এজেন্সি পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে গমনেচ্ছু নারীদের ‘প্রত্যাগত’ হিসেবে দেখানোর জন্য ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে। প্রকৃত আবেদনকারীর পরিবর্তে অন্য ব্যক্তির পাসপোর্ট নম্বর রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে আবেদন দাখিল করা হয়। এসব জাল পাসপোর্ট আসল হিসেবে উপস্থাপন করে বিএমইটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাঁদের সংরক্ষিত ডেটাবেস যাচাই না করে এজেন্সিগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে নয়জন জাল পাসপোর্টধারী নারীকে ছাড়পত্র প্রদানে অনুমোদনের জন্য নোট উপস্থাপন করেন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র লংঘন করে ২৫ বছরের কম বয়সি চারজন অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীকে ছাড়পত্র প্রদানে অনুমোদনের জন্য নোট উপস্থাপন করা হয়। এ কার্যকলাপে সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোকে জালিয়াতি ও নিয়মবহির্ভূতভাবে ছাড়পত্র গ্রহণে সহায়তা করা হয়। অভিযানকালে সংগৃহীত রেকর্ডপত্রের বিস্তারিত যাচাইয়ে দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়।
এরপর এনফোর্সমেন্ট টিমের প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে এবং কমিশনের অনুমোদনক্রমে নয়জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের ঢাকা-১ কার্যালয়ে একটি মামলা করা হয়। কিন্তু অভিবাসনসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিএমএটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এখানে আমূল সংস্কার না করলে দুর্নীতি বন্ধ হবে না, জনভোগান্তিও কমবে না।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন